জিয়াগঞ্জ
ভূমিকাঃ পশ্চিমবাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ
জেলা হল মুর্শিদাবাদ , আবার মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীনতম ক্ষুদ্র নগর হল জিয়াগঞ্জ ।
মুর্শিদাবাদ জেলা শিক্ষা , সংস্কৃতি , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে এই প্রাচীনতম
শহরটি হল জিয়াগঞ্জ । আর শিক্ষা সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা
প্রাচীন কাল থেকেই উন্নত বলেই মুর্শিদাবাদ
জেলার জিয়াগঞ্জ শহরটি জিয়াগঞ্জ বাসির মনের মণিকোঠায় আকড়ে ধরে আছে ।
প্রাচীন জাতি ও পরিবারের প্রভাবঃ মুর্শিদাবাদ
জেলা একটি বহুধর্মীয় ও বহু জাতির বসবাসকারী শহর বলে গণ্য । তার মধ্যে জিয়াগঞ্জ শহরটি
প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই বহু জাতির বসবাস লক্ষ্য করা যায় । আমরা এই তথ্য ভারতবর্ষের
ইতিহাসের পাতা থেকে জানতে পারি । প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এবং তাদের সাংস্কৃতিক
নিদর্শন থেকে জানতে পারি । এবং তাদের পারিবারিক অনেক তথ্য এই জিয়াগঞ্জ শহরে আজও প্রচলিত
আছে । এবং সমাজে তার প্রভাব কিঞ্চিৎ মাত্র রয়ে গেছে বর্তমান সমাজে ।
ভৌগলিক অবস্থানঃ জিয়াগঞ্জ নগরটি মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যস্থানে
অবস্থান করেছে । এই শহরটি উত্তরে ২৪.৫৮ ডিগ্রী এবং ৮৮.৫৫ ডিগ্রী অক্ষরেখায় অবস্থান
করেছে । জিয়াগঞ্জ শহরটির পশ্চিমদিকে ভাগিরথী নদী বয়ে চলে গেছে – যার অপর প্রান্তে আজিমগঞ্জ
শহরটি অবস্থান করেছে এবং পূর্বে জিয়াগঞ্জ রেল স্টেশন অবস্থান করেছে । ভাগিরথী নদীই জিয়াগঞ্জ - আজিমগঞ্জ শহর দুটিকে পৃথক করেছে এবং
শহর দুটির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিঃ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে জিয়াগঞ্জ শহরটি
শুধু মুর্শিদাবাদ নয় , সারা ভারতবর্ষে একটি
গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে । এই শহরে দুটি ডিগ্রী কলেজ আছে , যথা – কল্যাণী
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত জিয়াগঞ্জ শ্রীপৎ সিং কলেজ এবং রানি ধন্যা কুমারী কলেজ । এই ডিগ্রী কলেজ দুটি
মুর্শিদাবাদের দ্বিতীয় প্রাচীনতম কলেজ । তৎকালীন রাজা শ্রীপৎ সিং এবং তাঁর স্ত্রী রানি ধন্যা কুমারী কলেজ দুটি প্রতিষ্ঠা করেন, এছাড়া
একটি বি.এড. কলেজ ও একটি ডি.এড. কলেজ রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের তথ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালিত টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে । এছাড়াও এই শহরে প্রচুর পুরনো বিদ্যালয়
রয়েছে এই কারনে এই শহরটি শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি সাধন করেছে ।
সংস্কৃতির দিক দিয়েও জিয়াগঞ্জ শহরটি বেশ এগিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ
তথা ভারতবর্ষে । বর্তমানের বিশিষ্ট গায়ক অরিজিৎ সিং এই জিয়াগঞ্জ শহরেরই ছেলে – তিনি
এই ছোট্ট শহরেই সঙ্গীত চর্চা করেই ভারতবর্ষে তার সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছে । তাছাড়া
মুর্শিদাবাদ জেলা যুব উৎসবে জিয়াগঞ্জ – আজিমগঞ্জ ( বাক্যব্যায় দলটি ) নাটকে জেলায় প্রথম স্থান ( ২০১৪ সালে ) অধিকার করেছে
। এছাড়াও হাস্যরসিক মীর আজিমগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন । এর ফলে জিয়াগঞ্জ শহরটি সংস্কৃতির
ধারক ও বাহক হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব যায়গা বলে পরিচিত ।
অর্থনৈতিক অবস্থানঃ জিয়াগঞ্জ শহরটির অর্থনৈতিক অবস্থা
খুব একটা ভাল না হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে খারাপ বলা যাবে না । যদিও জিয়াগঞ্জ শহরের
অর্থনৈতিক অবস্থা মুর্শিদকুলি খাঁ – র শাসন কালের সময় থেকেই উন্নত মানের । এখানে অনেক
রাজা রানী শাসন চালিয়েছেন এবং তাঁরা এখানকার অর্থনীতিকে স্বচ্ছল করে দিয়ে গেছেন ।
রাজনৈতিক অবস্থানঃ মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ শহরটি বর্তমানে
জিয়াগঞ্জ – আজিমগঞ্জ পৌরসভার অধীনস্থ এবং পৌরসভাটি বামফ্রন্ট পরিচালিত । পৌরসভাটি বামফ্রন্ট পরিচালিত হলেও এখানে অন্যান্ন
দলেরও প্রভাব রয়েছে যেমনঃ সি.পি.আই.এম. , কংগ্রেস , বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস । এই
দল গুলি পৌরসভা পরিচালনা করার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ গুলিও পরিচালনা করে তবে , বর্তমানে
জিয়াগঞ্জ শ্রীপৎ সিং কলেজ এবং রানি ধন্যা কুমারী কলেজ দুটি ভারতের ছাত্র পরিষদ ( সি.পি.
) পরিচালিত ।
জীবিকা ও জনসংখ্যাঃ জিয়াগঞ্জ শহরটির জনসংখ্যা এক লক্ষ্যের
বেশী । তার ফলে এই শহরটির জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে ৩০০০- এর বেশী । তাই এই শহরটি
জনঘনত্ব পূর্ণ শহর । শহরটির অধিবাসীরা বিভিন্ন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে । এখানে
যেমন সরকারী চাকুরীজীবী রয়েছে তেমনই রয়েছে দিনমজুর – যারা দৈনিক কাজকর্ম করে তাদের
জীবিকা নির্বাহ করে থাকে ।
পরিকাঠামোগত অবস্থাঃ মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনটি লোকসভা রয়েছে
তার মধ্যে জিয়াগঞ্জ শহরটি মুর্শিদাবাদ লোকসভার অধীনে, এটি বর্তমানে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের
অধীনস্থ এবং এই শহরটি মুর্শিদাবাদ বিধানসভার অধীনে । তবে এই শহরটি জিয়াগঞ্জ থানার মুর্শিদাবাদ
– জিয়াগঞ্জ ব্লকের অন্তর্গত এবং লালবাগ মহকুমা-র অধীনে ।
চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীন শহর জিয়াগঞ্জের
চিকিৎসা ব্যবস্থা আজিমগঞ্জের থেকে একটু বেশী উন্নত হলেও খুব একটা উন্নত নয় । জিয়াগঞ্জে
চিকিৎসা কেন্দ্র বলতে একটি সরকারী হাঁসপাতাল যেটি নাম মাত্রই ও আরেকটি জিয়াগঞ্জ লন্ডন
মিশন হাঁসপাতাল ( খ্রিষ্টই সেবা সদন ) – ইংরেজ শাসন কালের একটি চিকিৎসাকেন্দ্র, যেটি
বর্তমানে জিয়াগঞ্জ – আজিমগঞ্জ পৌরসভা পরিচালনা করছে । এই হাঁসপাতালটি লন্ডন মিশন নার্সিংহোম
নামেও পরিচিত । এই নার্সিংহোমটি সম্পুর্ন সরকারী না হওয়ায় এখানে চিকিৎসা করানো খুব
ব্যায়বহুল যদিও সমস্ত পরিষেবা পাওয়া যায় না ।
পরিষেবাঃ জিয়াগঞ্জ শহরটি জিয়াগঞ্জ – আজিমগঞ্জ পৌরসভা বিভিন্ন
পরিষেবা দিয়ে এই শহরে একটি সূজনশীল পরিবেশ গড়ে তুলেছে । যেমন সুন্দর রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ
পরিষেবা, আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, জল নিকাসি ব্যবস্থা,
টেলিফোন পরিষেবা, ছোটো ছোটো শিশু উদ্যান ও খেলার মাঠ । এছাড়া বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা
ও প্রশাসনিক পরিষেবা জিয়াগঞ্জ বাসিরা খুব ভালই পেয়ে থাকে ।
যাতায়াত ব্যবস্থাঃ জিয়াগঞ্জ শহরটি মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যস্থলে
অবস্থিত হওয়ার কারনে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই ভাল । এই শহরটি সমতল ভূমি হওয়ায় সড়ক পথ,
রেল পথ, ও জল পথ ( ভাগিরথী নদী ধরে ) – এর বিশেষ সুবিধা রয়েছে । এছাড়া জিয়াগঞ্জ এবং
আজিমগঞ্জ শহরের সাথে যোগাযোগ নৌপথে হয় ( সদর ঘাট, নিমতলা ঘাট ) ।
পর্যটন কেন্দ্রঃ মুর্শিদাবাদ জেলা এতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র
হিসেবে ভারতবর্ষের মানচিত্রে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে । তবে জিয়াগঞ্জ শহরে পর্যটন কেন্দ্র
বলতে রয়েছে কিছু ছোট খাটো মন্দির ( যেমনঃ দাদস্থান মন্দির, কমলে কামেনি মন্দির ) ,
দু-একটি শিশু উদ্যান , ও দু-একটি পার্ক ( যেমনঃ বর্নালি পার্ক , বাগডহর পার্ক ) । তবে
পৌরউদ্যানটি এবং দাদস্থান মন্দিরটি পর্যটন কেন্দ্র রুপে কিছুটা জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে
।
অভাব ও অসুবিধাঃ ১) জিয়াগঞ্জ শহরটি ‘ডি’ ক্যাটাগরির একটি
পৌরসভা হওয়ায় এখানে আমরা নাগরিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত ।
২) এই শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা সমস্ত কোনে পৌঁছে গেলেও অনেক
জায়গায় রাস্তায় আলোর অভাব রয়েছে ।
৩) জিয়াগঞ্জ শহরের পথে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল থাকলেও
শহরের প্রতিটি ঘরে এখনো পৌঁছায়নি – এখানকার বেশিরভাগ মানুষ আর্সেনিক যুক্ত জল পান করে
।
৪) জিয়াগঞ্জ শহরে দুটি হাঁসপাতাল থাকলেও – উন্নত মানের
চিকিৎসা পদ্ধতি ও ভাল ডাক্তার এখানে নেই, এর জন্য সাধারণ মানুষকে ছুটে যেতে হয় সদর
শহর লালবাগ বা বহরমপুর বা কলকাতা ।
৫) এখানে রাজনৈতিক গোলযোগ একটু কম থাকলেও কলেজ গুলিতে
ছাত্র রাজনীতিতে মাঝে মাঝে গণ্ডগোল হয়ে থাকে ।
৬) এছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক , রাজনৈতিক সামাজিক
কিছু সমস্যা লেগেই থাকে ।
পরিশেষে , অনেক অভাব ও অসুবিধা থাকলেও জিয়াগঞ্জবাসী তাদের
এই শহরটিকে নিজের মনের মণিকোঠায় ধরে রেখেছে ।